খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের কেন্ডিলিবারের ছাদ ধসে হতাহতের ঘটনায় নানা প্রশ্ন উকি দিচ্ছে। এটি দুর্ঘটনা নাকি দায়িত্বে অবহেলা ? প্রকল্পের আসল ঠিকাদার কে? ঢালাইয়ের সময় কোনো প্রকৌশলী উপস্থিত ছিল না কেন? ঢালাইয়ের সময় ছাদের নিচে কেন লোহার পরিবর্তে বাশঁ দেওয়া হয়নি ঠেস দেওয়া হলো ? দোষীদের কি বিচার হবে নাকি ক্ষমতার দাপটে পার পেয়ে যাবে? ইত্যাদি নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। যদিওবা উদ্ধারকর্মী ও স্থানীয়রা হতাহতের ঘটনার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী ও ঠিকাদারের দায়িত্ব অবহেলাকে দায়ী করেছেন। কারণ ঢালাইয়ের সময় নিয়মনীতি মানা হয়নি।শুধু তাই নয়, প্রকল্পের প্রাক্কলন কত, কত সালে দরপত্র আহবান হয়েছে, কার লাইসেন্সের বিপরীতে হয়েছে। এ সব প্রশ্নের উত্তর এখনো জেলা পরিষদ থেকে মেলেনি।
তবে এসব প্রশ্নে উত্তর পেতে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ সোমবার (১০ অক্টোবর) পর্যন্ত অপেক্ষ করতে বলেন। তবে এ নিয়ে খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদ থেকে কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে।
একটি সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের দিকে কয়েক কোটি টাকার পার্বত্য জেলা পরিষদের পুরাতন ভবনের পিছনে নতুন প্রশাসনিক ভবন নির্মাণে গোপনে অখ্যাত পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে দরপত্র আহবান করা হয়। সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার উদ্দেশ্যে জনৈক উপজাতীয় ঠিকাদারের লাইসেন্সের বিপরীতে স্থানীয় আওয়ামী লীগের ৩ প্রভাবশালী নেতার নামে কৌশলে কাজ ভাগিয়ে নেন। কাজের নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হলেও দলীয় প্রভাব খাটিয়ে দফায় দফায় সময় বাড়ানো হয়। কিন্তু কার লাইসেন্সের বিপরীতে দরদাতা নির্ধারণ করা হয়েছে জানা যায়নি।
তবে কয়েকটি সূত্র জানায়, এ কাজের ঠিকাদার ছিলেন কৈলাশ ত্রিপুরা ও ক্যাজরী মারমা। আর সাব-ঠিকাদার ছিলেন প্রশন্ত কুমার দাশ। দুর্ঘটনার দিন প্রশান্ত দাশকে দিয়ে জেলা পরিষদ ভবনের কেন্ডিলিবারের ছাদ ঢালাই চলছিল। এ সময় ২২ জন শ্রমিক প্রায় ২৪ ফুট উঁচুতে কাজ করছিল। কিন্তু এত উঁচুতে কাজ করলেও ছাদের নিচে কোনও লোহার ঠেস দেওয়া হয়নি। দেওয়া হয়েছিল বাঁশ ঠেস। ফলে দুর্বল ঠেসের কারণে বাঁশগুলো অতিরিক্ত ভার রাখতে না পারায় ছাদে কাজ চলা অবস্থায় হঠাৎ তা ধসে পড়ে। । এতে ছাদের ওপরে শ্রমিকরা রক্ষা পেলেও নিচে থাকা বেশ কয়েকজন শ্রমিক চাপা পড়েন। এতে ২ শ্রমিক নিহত ও ৫ জন গুরুতর আহত হন। তবে কৈলাশ ত্রিপুরা ও ক্যাজরী মারমার নিজের কাজের ঠিকাদার নয় বলে দাবি করেছেন। ফলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে আসল ঠিকাদার কে?
খাগড়াছড়ি সদর থানার ওসি আরিফুর রহমান বলেন, জেলা পরিষদের পুরাতন ভবনের সামনে নতুন করে ছাদের একটি অংশ বর্ধিত করার কাজ চলছিল। এ সময় ছাদ ধসে পড়লে খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার সবুজবাগ এলাকার আমিনুল ইসলামের ছেলে সাজ্জাদ হোসেন (২২) ও বাগেরহাটের চিতলমারী থানার কালিগাতি এলাকার সোহরাব শিকদারের ছেলে সাইফুল ইসলাম (২২) মারা যান।
খাগড়াছড়ি ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ-সহকারী পরিচালক সাকরিয়া হায়দার দুর্ঘটনার জন্য ঠিকাদারের অবহেলাকে দায়ী করে বলেন, ‘ছাদ ঢালাইয়ের জন্য নিচে শক্ত লোহার খুঁটি ব্যবহারের দরকার ছিল। কিন্তু তা করা হয়নি।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের জনৈক সহকারী প্রকৌশলী বলেন, মূলত সেন্টারিং দুর্বল হওয়ায় এ ঘটনা ঘটেছে। বাঁশের সেন্টারিংয়ের চারদিকে টানা বাঁধ দিতে হয়। কিন্তু এই কাজে টানা বাঁধ দেওয়া হয়নি। ফলে অতিরিক্ত ভারে ধসেটি পড়েছে ছাদ। তাহলে জেলা পরিষদের তদারকি কাজে নিয়োজিত প্রকৌশলী কেন কাজে বাধা দেননি এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে চাননি তিনি।
তবে বিষয়ে কথা বলতে শনিবার (৮ অক্টোবর) থেকে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাহী প্রকৌশলী তৃপ্তি শংকর চাকমা, সহকারী প্রকৌশলী প্রশান্ত কুমার হালদারকে দফায় দফায় ফেন দেওয়া হলেও পাওয়া যায়নি।
আরো দু:খজনক ঘটনা হচ্ছে, ঘটনার প্রায় ২ ঘন্টা পার হয়ে গেলেও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের কোন কর্মকর্তাকে ঘটনাস্থল ও হাসপাতালে পাওয়া যায়নি। তবে খবর পেয়ে জেলার মাটিরাঙার একটি কর্মসূচি বাদ দিয়ে সন্ধ্যা ঘটনাস্থলে পৌছেন খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মংসুইপ্রু চৌধুরী। তিনি তাৎক্ষণিত শ্রমিক হতাহতের অনাকাঙ্খিত ঘটনার কারণ উদঘাটন ও দায়-দায়িত্ব নির্ধারণের শনিবার রাতে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন ও দুর্ঘটনায় যারা মারা গেছেন তাদের পরিবারকে এক লাখ টাকা করে সহযোগিতা এবং যারা আহত হয়েছেন তাদের সু-চিকিৎসার দায়িত্ব নেন। একই সাথে গঠিত কমিটিকে সাত কার্যদিবসে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য নির্দেশ দেন।
এ দিকে সরকারি ছুটির দিনে কোন প্রকৌশলী উপস্থিতি ছাড়া কাজ করা সাব-ঠিকাদার প্রশন্ত কুমার দাশ-কে তা নিয়ে নানা প্রশ্ন জন্ম দিচ্ছে। তদারকি প্রকৌশলী ছাড়া কীভাবে প্রশস্ত কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন এমন প্রশ্নের জবাব নেই কারো কাছে। এখন দেখার বিষয় সুষ্ঠু তদন্ত আদৌ হবে কি না ? কিংবা তদন্ত প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখবে কি না? দোষীরা কি শাস্তি পাবে? নাকি খাগড়াছড়িতে স্কুলের গেইট চাপায় শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের মতো যাতে ধামাচাপা পড়ে না যায়।