পার্বত্য চট্টগ্রামে মুরুং জনগোষ্ঠীর গুটি কয়েক মানুষ ‘রেংমিৎচা’ ভাষা জানেন। কিন্তু তারা এ ভাষায় আর কথা বলেননা। কারণ এ ভাষাভাষীর সংখ্যা বর্তমানে হাতে গোনা। তাই কথা বলার লোকের অভাবেই রেংমিৎচা ভাষীরা বর্তমানে ম্রো ভাষায় কথা বলেন।
সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, পাহাড়ি জেলা বান্দরবানের আলীকদম উপজেলায় বর্তমানে রেংপুং হেডম্যানপাড়া ও ক্রাঞ্চিপাড়ায়‘রেংমিৎচা ভাষা’ জানা মুরুং রয়েছেন মাত্র ৪ জন। পার্শ্ববর্তী নাইক্ষ্যংছড়ির ওয়াই বটপাড়া ও কাইনওয়াই পাড়ায় রয়েছেন আরও ২ জন। এ ছাড়া দেশের অন্য কোথাও পুরোপুরি এ ভাষা জানেন এমন লোক থাকার তথ্য-উপাত্ত নেই। পার্বত্য চট্টগ্রামের ম্রো জনগোষ্ঠীর ক্ষুদ্র একটি অংশের মাঝে এখনো প্রচলিত ‘রেংমিৎচা’ নামের ভাষাটি অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে।
রেংমিৎচা ভাষা নিয়ে মাঠপর্যায়ে ২০১৩ সালে থেকে গবেষণায় জড়িত ইয়াঙান ম্রোর মতে, বর্তমানে দেশে পুরোপুরি রেংমিৎচা ভাষা জানেন ৬ জন। আরও ১০/১২ জন ম্রো কিছুটা রেংমিৎচা জানেন। তবে তারা কেউ এ ভাষায় এখন আর কথা বলেনা।
ষাটের দশকে রেংমিৎচা ভাষাভাষীদের প্রথম খুঁজে বের করেন জার্মান ভাষাবিদ লরেন্সজি লোফলার। তারপর এ ভাষা নিয়ে আর খুব একটা কাজ হয়নি। মার্কিন গবেষক ডেভিড এ পিটারসন ২০১৩ সালে থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে রেংমিৎচা ভাষা নিয়ে গবেষণা করেন। তার সহযোগি ছিলেন স্থানীয় ম্রো যুবকইয়াঙান ম্রো গবেষক ডেবিট এ পিটারসন ২০১৫ সালে রেংমিৎচা ভাষাভাষি খুঁজে পান আলীকদম উপজেলার তৈনফা মৌজায়।
ভাষাবিজ্ঞানী ডেভিড এ পিটারসন সে সময় আলীকদমে রেংমিৎচা ভাষাভাষী ১২ জনের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ রেকর্ড করতে সক্ষম হন। ২০১৫ সালের ১২ জানুয়ারি তিনি বান্দরবান প্রেসক্লাবে রেংমিৎচা ভাষা জানা কয়েকজন ম্রো সঙ্গে রেংমিটচা ভাষা পুনরুদ্ধারের বিষয়টি সাংবাদিকদের জানান।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের ডকুমেন্টিং এন্ডে নজার্ড ল্যাগুয়েজেস প্রোগ্রামের মাধ্যমে ডেভিড এ পিটারসনএ অনুসন্ধানকরেন। এ ভাষার বর্ণমালা, ধারণাপত্র তৈরি ও সর্বক্ষেত্রেই ব্যবহার উপযোগী করতে তিনি গবেষণা অব্যাহত রাখার কথা বলেছিলেন।
সরেজমিন অনুসন্ধকালে রেংমিৎটচা ভাষী রেংপুং ম্রো হেডম্যানের সাথে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। এ সময় রেংপুং হেডম্যান জানান, তার বয়স এখন ৭১। তিনি রেংমিৎচা ভাষা জানলে ও এ ভাষায় কথা বলেননা। এর কারন হিসেবে জানান, রেংমিৎচা ভাষা জানা লোক এখন বেশী নেই। মাত্র ৫/৬ জন পুরোপুরি জানেন। তারা সকলেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তাই কথা বলার মতো আশেপাশে কেউ না থাকায় তারা ম্রো ভাষায় কথা বলেন।
রেংপুং ম্রো আলীকদম উপজেলার ২৯১নং তৈনফা মৌজার হেডম্যান। তিনি বলেন, তার ছেলে মেয়েনাতি সকলেই ম্রো ভাষায় কথা বলেন। তাদের কেউ রেংমিৎচা ভাষা পুরোপুরি জানেননা। কেউ শিখতেও চায়না। তবে তার আশা নতুন প্রজন্মের তরুণরা রেংমিৎচা ভাষাকে আগলে রাখবে, হারিয়ে যেতে দেবে না!
রেংপুং ম্রোর বিশ্বাস, সৃষ্টির আদিকাল থেকেই রেংমিৎচা ভাষী লোকজন ছিলেন। এখন কমে গেছে। ১৯৪০ সালে পার্বত্য আলীকদম এলাকার তৈন খাল তীরবর্তী স্থানেমুরুং বসতি ছিলো। সে সময় ৬/৭ হাজার মুরুং জনগোষ্ঠীর লোকজন রেংমিৎচা ভাষায় কথা বলতেন। কিন্তু কালের গর্ভে এ ভাষায় কথা বলা লোকের সংখ্যা ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে।
বান্দরবানের প্রবীন সাংবাদিক মনিরুল ইসলাম মনু জানান, ‘রেংমিৎচা’ স্বতন্ত্র কোনো ভাষা নাকি ম্রো ভাষার একটি উপভাষা, তা নিয়ে বিশদ ভাবে কোনো গবেষণা হয়নি।একজন ব্রিটিশ গবেষক আলীকদমের তৈনখাল এলাকা ঘুরে এ ভাষা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেন। পরে বান্দরবান প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে তিনি গবেষণার বিষয় তুলে ধরেছিলেন।
রেংমিৎচা ভাষা নিয়ে গবেষণা বলতে এটিই একমাত্র উদ্যোগ। এর বাইরে রেংমিৎচা ভাষা নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো কাজ শুরু হয়েছে বা চলছে, এমন তথ্যও কেউ জানাতে পারেননি।’
তরুণ গবেষক ইয়াঙান ম্রো জানান, বর্তমানে রেংমিৎচা ভাষাভাষি লোকজন এতই কম যে, ইচ্ছে করলেও তিনি কিংবা অন্য যাঁরা এ ভাষা জানেন তারা কথা বলতে পারেননা। এ ভাষা জানা লোক এখন হাতে গোনা। তাই নিজেদের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ হলেই কেবল রেংমিৎচা ভাষায় কথা বলেন তারা। অন্যসময় সকলেই ম্রো ভাষায় কথাবলে থাকেন।
রেংপুং হেডম্যান বলেন, তৈনফা মৌজার প্রথম হেডম্যান তাঁর নানা তাংলিং ম্রো, বাবাউকলিং ম্রো ও চাচাইয়াংইয়ুন ম্রো শতভাগ রেংমিৎচা ভাষায় কথা বলতেন। তারা মারা গেলে পরবর্তী প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা আর রেংমিৎচা ভাষা রপ্ত করেনি। এক সময় তৈনখাল এলাকার ক্রাংচিপাড়া, পায়াকার্বারি পাড়া ও টিংকুপাড়ায় রেংমিৎচা ভাষাভাষীরা ছিল। বর্তমানে রেংপুং হেডম্যান ছাড়াও মাংপুং ম্রো, তিংওয়াই কার্বারি ও লাউলী ম্রো, রেংমিৎচা ভাষা ভালো ভাবেব লতে পারেন। রেংপুং হেডম্যানের বড় মেয়ে কাইতুন ম্রো কিছুটা এ ভাষায় কথা বলতে পারেন।
গবেষক ইয়াঙান ও রেংপুং হেডম্যানের মতে, রেংমিৎচা এবং ম্রো ভাষা সম্পূর্ণ আলাদা। তবেযারা রেংমিৎচা ভাষায় কথাবলেন, তারা জাতীতে ম্রো জনগোষ্ঠীর লোক। এরা বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। ম্রোদের কেউ কেউ বর্তমানে খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করলেও এ পর্যন্ত রেংমিৎচা ভাষাভাষী ম্রোরা বৌদ্ধ ধর্মই পালন করেন। তাদের কেউ ধর্মান্তর হননি।