পাহাড়ে ফুটবলার তৈরির কারিগর শান্তি মণি চাকমা। তিন দশক ধরে তিনি ফুটবল প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছেন । সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ী বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ নারী ফুটবল দলের পাঁচ খেলোয়াড়—মনিকা, আনুচিং, আনাই মোগিনি, রুপনা, ঋতুপর্ণা তাঁর হাতেই তৈরি। জাতীয় দৈনিক কালের কান্ঠের প্রতিবেদক আল সানির মাধ্যমে উঠে এসেছে এসব খেলোয়াড়ের উঠে আসার গল্প।
২০১০ সালের কথা। হঠাৎ খবর পেলাম মঘাছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মেয়েদের ফুটবলের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। খবর পাঠিয়েছেন বিদ্যালয়টির তৎকালীন প্রধান শিক্ষক বীর সেন চাকমা। তাঁর ডাক উপেক্ষা করতে পারলাম না।
ফুটবলের সঙ্গে আমার প্রেম প্রায় ৩০ বছরের। একসময় খেলতাম। এখন ছেলেমেয়েদের খেলা শেখাই। ১০ বছর আগে মঘাছড়ির মাঠে যখন আনুচিং, ঋতুপর্ণা, রুপনাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করি, তখন ওদের একেবারে অল্প বয়স। ক্লাস থ্রি কি ফোরে পড়ে সবাই। ঠিকমতো বলে পা লাগাতে পারে না। তাদের ধরে ধরে শিখিয়েছি কীভাবে বল খেলতে হয়। সেই সাত-আট বছরের কোমল মেয়েগুলো আজ সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ চ্যাম্পিয়ন!
প্রথম দিকে ৩০ জনের বিশাল একটা দল দেওয়া হলো আমাকে। প্রতিদিন প্রশিক্ষণ দিতে যেতাম আর দেখতাম আগের দিনের তুলনায় মেয়েদের সংখ্যা কমে আসছে। অনেক পরিবার মেয়েদের খেলাধুলা পছন্দ করে না, আবার অনেকে ফুটবলের সঙ্গে মানিয়ে উঠতে পারছিল না। তবু একটা বড় দল আমার সঙ্গে থেকে যায়। এর আগে আরো দুটি স্কুলের খেলোয়াড়দের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলাম। কিন্তু সেই দুটি দলের মধ্যে একাগ্রতা ও ফিটনেসের যে ঘাটতি ছিল এই কিশোরীদের মধ্যে তা দেখিনি। রাঙামাটির মেয়েরা উঁচু উঁচু পাহাড় আর নির্মল বাতাসে বড় হয়েছে। ফুটবল মাঠে প্রতিপক্ষকে দেখে তারা ভয় পায় না।
যা হোক, টানা এক বছর সকাল-বিকাল প্রশিক্ষণ চলল। কিন্তু ফুটবল প্রশিক্ষণে যত সরঞ্জাম লাগে সেগুলো বেশ ব্যয়বহুল ছিল আমাদের জন্য। বীর সেনদা আর আমি সবটা দিয়ে চেষ্টা করছি অভাবটা পূরণ করতে। ২০১১ সালে বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ যখন শুরু হবে তখন বীর সেনদার হাতে একটি গোছানো দল তুলে দিলাম। বললাম, ‘দাদা, এবার আমার ছুটি নেওয়ার পালা। ’ আমার দলটা নিরাশ করেনি। আনাই মোগিনি, আনুচিং মোগিনি, রিতুপর্ণা, রুপনা—সবাই তাদের সেরাটা দিয়ে সেবার বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ জিতে নেয়।
২০১২ সালে প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে প্রায় সবাই ঘাগড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে যায়। পরের বছর ঘটে আরেক কাহিনি। সেবার বিভাগীয় পর্যায়ে চট্টগ্রামের খেলা দেখতে যান বীর সেনদা। লক্ষ্মীছড়ি মনাচেঙ্গী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মনিকা চাকমার খেলা দেখে মুগ্ধ হন। ২০১৩ সালেই তিনি মনিকাকে ঘাগড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি করান।
ফলে পার্বত্য এই অঞ্চলের সেরা সব ফুটবলার এক ছাদের নিচে এলো। তখন এই দলকে আবার আমার হাতে তুলে দেওয়া হলো। পুরনো শিষ্যদের পেয়ে নতুন উদ্দীপনায় প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করলাম। জাতীয় স্কুল ও মাদরাসা ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় বালিকা ফুটবলে ঘাগড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের হয়ে আমরা পর পর তিনবার রানার্স আপ হয়েছিলাম। হেরেছিলাম কলসিন্দুরের মেয়েদের কাছে। ২০১৬ সালে জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। এ ক্ষেত্রে এখনকার প্রধান শিক্ষক চন্দ্র দেওয়ান বেশ সহযোগিতা করেছেন।
মনিকার বাড়ি খাগড়াছড়ির লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার সুমন্তপাড়ায়। এলাকায় সবাই চেনে। তাই বাইরে থেকে নতুন কেউ এলে এলাকার মানুষ জানতে চায় ‘মনিকার বাড়ি যাবেন?’ মনিকা মাঝে মাঝে এসব গল্প করে আমার কাছে। যদিও অন্যরা আমাকে খুব ভয় পায়। তবে এই ভয়টা শ্রদ্ধামিশ্রিত। এরা যখন জাতীয় পর্যায়ে খেলা শুরু করে তখন শুক্রবার ছাড়া মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারত না। এখনো শুক্রবার মোবাইল হাতে পাওয়ার পর সবাই একবার হলেও আমার সঙ্গে কথা বলবেই। আনাই আর আনুচিং মোগিনি তাদের বাবাকে ছাড়া কোথাও থাকতে পারে না। এই সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ নারী চ্যাম্পিয়নশিপেও ঢাকায় দুই বোনের সঙ্গে তাদের বাবা ছিলেন। এদিক থেকে তিনি ভাগ্যবান। মেয়েদের প্রতিটি জয় কাছ থেকে দেখেছেন। এখানে দুঃখের ব্যাপারও আছে। রাঙামাটিতে বেশ কিছু প্রতিভাবান মেয়ে ছিল। আনাইদের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। তবে তারা মা-বাবা ছাড়া থাকতে পারবে না বলে চলে যায়। ওই খেলোয়াড়দের পেলে ভারতকে হয়তো আরো বেশি ব্যবধানে হারাতে পারতাম। শুরুর দিকে হোস্টেলে সমস্যা ছিল বলে কয়েকজনকে আমার বাসায় রেখেছিলাম। রুপনা ছিল এখানকারই আরেকজন শিক্ষক নলিনী চাকমার বাসায়।
আমাদের এখানে একেবারে সমতল মাঠ খুব কম, তবে উঁচু-নিচু যেসব উপত্যকা আছে, সেখানে খালি পায়ে ফুটবল খেলে সবার পা এতটাই শক্তিশালী হয়েছে, তারা ফুটবল আর প্রতিপক্ষ দুটিকেই বশে রাখতে পারে। তবে যা দিয়ে গেলাম সেটা যেন বাংলাদেশ ধরে রাখে, নইলে আফসোসের অন্ত থাকবে না।