রবিবার, ২৬ মার্চ ২০২৩, ১০:৩৩ অপরাহ্ন

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য জাতিসংঘের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান

ডেস্ক রিপোর্ট
  • প্রকাশিত: শুক্রবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২
  • ২১ পঠিত

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টেকসই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে শক্তিশালী ও বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। একই সঙ্গে পাঁচটি পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ করেন তিনি।

বৃহস্পতিবার (২২ সেপ্টেম্বর) স্থানীয় সময় সকালে নিউইয়র্কের হোটেল লোটে প্যালেসে ‘রোহিঙ্গা সংকট’ বিষয়ে একটি হাই-লেভেল সাইড ইভেন্টে প্রধানমন্ত্রী এ আহ্বান জানান।

দীর্ঘ সময় পার হলেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন না হওয়ায় আক্ষেপ প্রকাশ করে এ ইভেন্টে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, একজন রোহিঙ্গাকেও তাদের মাতৃভূমিতে ফিরতে না দেখেই গত মাসে আমরা দীর্ঘায়িত রোহিঙ্গা সংকটের ষষ্ঠ বছরে পা দিয়েছি। তাদের টেকসই প্রত্যাবর্তনের পরিবেশ সৃষ্টিতে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের বাস্তব পদক্ষেপ এবং প্রকল্প গ্রহণ করা প্রয়োজন।

জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো শক্তিশালী ভূমিকা নেবে আশা প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ ন্যায়বিচার থেকে দায়মুক্তির বিরুদ্ধে এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে যেকোনো উদ্যোগকে সমর্থন করবে। যদিও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, জাতিসংঘ এবং আশিয়ানের বর্তমান ফোকাস মিয়ানমারে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনা- মিয়ানমারের জনগণের জন্য শান্তি ও ন্যায়বিচার আনতে এবং নিজেদের জন্মভূমিতে রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ এই সংস্থাগুলোর শক্তিশালী ভূমিকার জন্য অপেক্ষা করছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, কিছু নির্বাচিত ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা মিয়ানমারের উপর প্রভাব ফেলতে পারে না। সংকট সমাধানে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের রাজনৈতিক সদিচ্ছা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মিয়ানমারের সঙ্গে বাণিজ্য ও সামরিক সম্পর্ক বৃদ্ধি মিয়ানমারের স্বার্থকে বাড়িয়ে তুলছে। বাংলাদেশ মনে করে- রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবাসন এবং একটি টেকসই সমাধান খুঁজে পেতে আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার ও জবাবদিহিতার প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে আসিয়ানের শক্ত ভূমিকা প্রত্যাশা করে শেখ হাসিনা বলেন, এ সংকট নিরসনে আঞ্চলিক সংস্থা হিসেবে আশিয়ান প্রধান ভূমিকা নিতে পারে। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব নিশ্চিতে রাখাইন রাজ্যের ওপর কফি আনান উপদেষ্টা কমিশনের সুপারিশগুলো সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়নের ব্যাপক প্রচেষ্টা গ্রহণ করা উচিত। বেসামরিক পর্যবেক্ষক হিসেবে তাদের অর্থবহ উপস্থিতি স্বেচ্ছায় নিজের মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তনের জন্য রোহিঙ্গাদের আত্মবিশ্বাস বাড়াবে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রোহিঙ্গাদের রাজনৈতিক ও আর্থিকভাবে সমর্থন; আন্তর্জাতিক আইনের প্রয়োগ এবং মিয়ানমারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে লড়াই জোরদার করতে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গাম্বিয়াকে সমর্থন করা- আন্তর্জাতিক বিচার আদালত, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত এবং জাতীয় আদালতের সামনে কার্যক্রমে সহায়তা; জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অব্যাহত দমন-পীড়ন বন্ধে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি; আসিয়ানের পাঁচ-দফা ঐক্যমত্যের অধীনে মিয়ানমারকে তাদের প্রতিশ্রুতি মেনে চলতে বলা, দৃঢ়ভাবে বলা ও বাধাহীন মানবিক প্রবেশাধিকারের জন্য মিয়ানমার যাতে সম্মত হয় সেই প্রচেষ্টা চালানোর মতো পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

ঐতিহাসিকভাবে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক জানিয়ে সরকার প্রধান বলেন, অষ্টম শতাব্দী থেকে রোহিঙ্গারা আরাকানে বসবাস করছে, যা এখন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য। ১৯৪৮ সালে মিয়ানমার যখন স্বাধীন হয়, নতুন সরকার কোন কোন জাতিসত্তা নাগরিকত্ব পেতে পারে তা সংজ্ঞায়িত করে নাগরিকত্ব আইন পাস করে। এতে রোহিঙ্গাদের ভিন্ন জাতির বহিরাগত হিসেবে টার্গেট করা হয়েছে। তারপরে ১৯৮২ সালে নতুন একটি নাগরিকত্ব আইন পাস করা হয়েছিল যেটি রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে থাকা ১৩৫ জাতিগোষ্ঠীর একটি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি।

তিনি আরও বলেন, ১৯৫২ সালে যখন ইউ নু রাষ্ট্রপতি হন, তিনি তার মন্ত্রিসভায় দুন মুসলিম রোহিঙ্গাকে অন্তর্ভুক্ত করেন- বাণিজ্য ও উন্নয়ন মন্ত্রী হিসাবে ইউ রশিদ এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রী হিসেবে সুলতান মাহমুদকে। তার পার্লামেন্টে আব্দুল বাশার, জোহোরা বেগম, আবুল খায়ের, আবদুস সোবহান, রশিদ আহমেদ, নাসিরুদ্দিন এবং দুজন সংসদীয় সচিব, সুলতান আহমেদ এবং আব্দুল গাফফার নামে ছয়জন মুসলিম রোহিঙ্গা ছিলেন। এটি প্রমাণ করে মুসলিম রোহিঙ্গারা এখনও মিয়ানমারের নাগরিক এবং একজন নাগরিক হিসেবে মুসলিম রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের মন্ত্রিসভা এবং সংসদে থাকতে পারে।

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনই এ সংকটের একমাত্র সমাধান সে কথা পুর্নব্যক্ত করে শেখ হাসিনা বলেন, বর্তমান সংকটের উৎপত্তি মিয়ানমারে এবং সেখানেই এর সমাধান রয়েছে। রোহিঙ্গাদের পদ্ধতিগতভাবে বাদ দেওয়া এবং নির্বিচার নিপীড়নের মাধ্যমে মিয়ানমার সরকার ১৯৬০ সাল থেকে রোহিঙ্গাদের অব্যহতভাবে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে। আজকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া জোরপূর্বক বিতাড়িত মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিকের সংখ্যা ১ দশমিক ২ মিলিয়ন (১২ লাখ) এবং ক্যাম্পে প্রতিদিন শিশুর জন্ম হচ্ছে।

শান্তিপূর্ণভাবে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বাংলাদেশের প্রচেষ্টার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শুরু থেকেই বাংলাদেশ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটি টেকসই ও শান্তিপূর্ণ সমাধান চেয়েছে। ২০১৭ সালে গণহারে রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার পর রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনে দুই দেশ তিনটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। প্রত্যাবাসন শুরু করার জন্য ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে দুটি প্রচেষ্টাও চালানো হয়েছিল। কিন্তু রাখাইনে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়ায় বাছাই করা সেসব রোহিঙ্গারা ফিরতে রাজি ছিল না। তাদের নিরাপত্তা ও নিরাপত্তা, সহিংসতার পুনরাবৃত্তি না হওয়া, জীবিকার সুযোগ এবং নাগরিকত্বের পথসহ মৌলিক অধিকারের ইস্যুগুলো তাদের উদ্বেগের কারণ ছিল।

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘মিয়ানমারের অব্যহত প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের প্রেক্ষিতে, বাংলাদেশ ত্রিপক্ষীয় মেকানিজমের মাধ্যমে চীনের সহায়তায় নতুন করে প্রত্যাবাসন আলোচনা শুরু করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত, এতে খুব একটা অগ্রগতি হয়নি।’ তিনি বলেন, কক্সবাজারে এখন বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী শিবির রয়েছে। এখানে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ মানবিক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তায়, বাংলাদেশ এই বাস্তুচ্যূত রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও কল্যাণে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদেরকে খাবার, আশ্রয়, স্বাস্থ্যসেবা ও অন্যান্য সেবা প্রদান করা হচ্ছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ তার জাতীয় কোভিড টিকাদান কর্মসূচিতে রোহিঙ্গাদেরও অন্তর্ভূক্ত করেছে। বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের ভাষায় পাঠ্যক্রম অনুসরণ, দক্ষতা বৃদ্ধি কার্যক্রম ও জীবিকা অর্জনের সুযোগ পাচ্ছেন। এটা তাদের সংস্কৃতি ও ভাষা চর্চার অবদান রাখছে এবং দেশে ফিরে নিজস্ব সমাজে মিশে যেতে সহায়ক হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অস্থায়ীভাবে প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গাকে স্থানান্তরের জন্য আমরা নিজস্ব অর্থে ৩৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে ভাসান চর নামে একটি দ্বীপকে মানুষের বাসযোগ্য করে তুলেছি। এখন পর্যন্ত, প্রায় ৩১ হাজার রোহিঙ্গাকে সেখানে স্থানান্তর করা হয়েছে।’

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Let's check your brain 19 − 12 =

একই ধরনের আরও সংবাদ
© All rights reserved 2022 CHT 360 degree