রবিবার, ০১ অক্টোবর ২০২৩, ০৬:৩৫ অপরাহ্ন

ল্যংটা কুকিদের রাজ্য থাকলেও শিক্ষিত চাকমারা কেন রাষ্ট্রহীন?

প্যারিস চাকমা
  • প্রকাশিত: রবিবার, ২৩ অক্টোবর, ২০২২
  • ৪০ পঠিত

একদা চাকমারা যাদের ল্যংটা কুকি বলতে। আজ তাদের স্বশাসিত রাজ্য আছে, যা ত্রিপুরা রাজ্য থেকেও দ্বিগুণ বড়। অবাকের বিষয় তাদের এই ভূমি আবার চাকমাদের পাশের ভূমি মিজোরাম। বিশ্বের ইতিহাস ভুলে যান। অন্তত চাকমা ও কুকিদের ইতিহাস নিয়ে পড়ুন। এতে অন্তত ধারণা নিতে পারবেন আমাদের ভুলগুলো ঠিক কোথায় ছিল, আছে এবং ভবিষ্যতের জন্য আমাদের কেমন হওয়া উচিত। জানলে শুধু আফসোস নয়, লজ্জিতও হবেন।

বৃটিশ পাবর্ত্য চট্টগ্রাম শুরুর দিকে রাঙমাটি ও বান্দরবানের বিশাল অঞ্চল ছিল কুকিদের বিচরণ ভূমি । রাঙমাটি সদর ও কাপ্তাই ছিল তাদের সীমান্তবর্তী এলাকা। তাদের জীবন-জীবিকা ও লেন -দেন সবকিছু ছিল চট্টগ্রাম ভিত্তিক । কর্ণফুলী নদী ছিল তাদের একমাত্র পরিবহন মাধ্যম যেটি তাদের মূল ভূমি লুসাই হিল থেকে উৎপত্তি লাভ করে। বৃটিশরা তাদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান না চালালে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশাল ভূমি আজও তাদের দখলে থাকতো।

চাকমা ও কুকিদের নেতৃত্ব ধরণ:
চাকমা-মারমাদের মত কুকিদের চিফ থাকলেও নিজ জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সুপ্রিমেসি, শাসন ও শোষণ মনোভাব ছিলোনা বলে তারা নিজেদের রাজা দাবি করেননি। চিফ বলতে তারা লিডারশিপ ও রেস্পন্সিবিলিটিকে বুঝতেন। তাই কুকিদের মধ্যে শাসন ও শোষণ বলতে কিছুই ছিলোনা। ফলে শ্রেণি গড়ে উঠতে পারেনি। JP Mills এর রিপোর্টে দেখা যায় যে, চাকমা রানী কালিন্দী উপদেষ্টা ও অর্থ দপ্তরে বাঙালি নিয়োগ করে চাকমাদের সর্বশান্ত করেছিল যা কুকিদের বেলায় ঘটেনি। এর পরবর্তীতে আরো একটি শোষণের ওয়েভ হলো রাজা ও দেওয়ানদের। ১৮৩২ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ প্রায় ১০০ বছরের অধিক চাকমা চিফরা এবং তাদের কর্মচারী দেওয়ানরা নিজেরা ও বাঙালি দিয়েই নিজ জাতি চাকমাদের শোষণ করেছিল। ( JP Mills Reports – 1926/1927 )। দেখবেন কোন অঘটন ঘটলে আগে চাকমারা পালানোর রাস্তা খুঁজে। চাকমাদের এই মাইন্ডসেট একদিনে সৃষ্টি হয়নি, এটা শত বছরের নিজ জাতিগোষ্ঠীর চিফ ও তাদের কর্মচারীদের শোষণের রেজাল্ট।

কুকি চিফরা নেতৃত্ব বলতে যা বুঝতেন তা হলো কুকি জাতিগোষ্ঠীদের ভূমি ও অস্তিত্ব রক্ষার্থে নেতৃত্ব প্রদান করা। ফলে নেতাদের মধ্যে এলিট ভাব , শোষণ, অত্যাচার, অর্থ ও ক্ষমতা লোভ প্রবণতা কাজ করতোনা। কুকিদের নেতা ও নেতৃত্ব মানার কারণ এটাই। তাই চিফ বা নেতাদের যা নির্দেশ তা সবাই অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন । নেতৃত্বের ফলে চাকমাদের মত তাদের মধ্যে শ্রেণি গড়ে উঠতে পারেনি। ফলে ইকুয়ালিটি ও ইউনিটি হয়ে ওঠে তাদের মূল শক্তি যা আজ বহমান।

ভূমি ও বাঙালিদের ভীতি :
আগেই বলেছি ভূমি হলো কুকিদের অস্তিত্ব। তাদের দুধর্ষ হয়ে ওঠার মূল ফ্যাক্ট হলো ভূমি। কারণ ভূমি থাকবেনা, অস্তিত্বও থাকবেনা।
সমতলের বাঙালিরা যে জঙ্গল দেখলে ভয় পেতেন তা চাকমা-মারমাদের কারণে নয়, কুকিদের দুধর্ষ হামলার কারণে। কুকিরা নিজ ভূমিতে তো দূরের কথা তাদের ভূমির আশে-পাশেও বহিরাগতদের দেখতে চাইনা। আঠারো শতকের মধ্যভাগে চট্টগ্রাম সীমান্ত এলাকা বরাবর তারা বড় বড় হামলা করতেন, যেন বহিরাগতরা পাহাড়ে প্রবেশ করতে না পারে। এসব হামলার মাধ্যমে তারা পাহাড়ে প্রবেশে বাঙালিদের ঠেকিয়েছিলেন। আজ পার্বত্য চট্টগ্রামে ১ লক্ষ কুকির বসবাস হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম আজও বাঙালি মুক্ত থাকতো।

পক্ষান্তরে , চাকমা চিফদের ভূমির প্রতি কোন টান ছিলোনা। রানী কালিন্দী বাঙালিদের দিয়ে চাকমাদের ভূমিছাড়া করেছিল যে ব্রিটিশ কমিশনারদের রিপোর্টে উল্লেখ রয়েছে । ফলে চাকমারা ধীরে ধীরে সমতল ছেড়ে পাহাড়ে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়। পাহাড়ে এসেও চাকমাদের শান্তি ছিলোনা। চট্টগ্রাম থেকে রাঙমাটিতে চাকমা রাজাবাড়ী স্থানান্তর করা হলে সেখানে রাজা ও রাজন্যবর্গরা চাকর হিসেবে সমতল থেকে বাঙালি নিয়ে আসে। শত শত বাঙালি পরিবার চাকমা সামন্তশ্রেণিদের জমিতে চাষ করতে থাকে। যেখানে বাঙালি ঠেকাতে কুকিরা হামলা চালাতো, সেখানে চাকমা সামন্ত শ্রেণিরা বাঙালিদের ধরে নিয়ে আসে বসতি করে দেয়।

স্বকীয়তা
কুকিরা কখনো নিজেদের স্বকীয়তা বিসর্জন দেয়নি। আসাম, ত্রিপুরা ও বাংলাদেশ এই তিন সীমানার ভিতরে তাদের অবস্থান হলেও কোন সংস্কৃতি তাদের গ্রাস করতে পারেনি। শত বছরের স্বকীয়তা আজও বহমান। বাঙালি পোশাক পরিধান রাজা-রাণী এবং রাজন্যবর্গদের দিয়ে প্রচলন হয়। রাজা ভুবন মোহন ছিলেন আগা গোড়া বাঙালি প্রীত। যাকে প্রথম দেখে JP Mills বিস্মিত হন। তিনি এতোটা বাঙালি প্রীতি যে, নিজ দুই ছেলের জন্যে বাঙালি মেয়ে বউ করে নিয়ে আসেন। আজকের যারা রায় পরিবারের সদস্য তাদের প্রত্যেকের শরীরে বাঙালি রক্ত প্রবাহমান। রক্ত পর্যন্ত তার স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলে। চাইলেও তুমি তাদের চাকমা বানাতে পারবেন না। তাদের চিন্তা ভাবনা অন্য লেভেলের।

কুকিরা চাকমাদের থেকে অনেক দেরিতে শিক্ষার আলো পেলেও তাদের কারিকুলাম ইংরেজি বর্ণমালায় নিজ ভাষা। কারণ তাদের বর্নমালা ছিলোনা। পক্ষান্তরে চাকমাদের বর্ণমালা থাকা সত্ত্বেও রাঙমাটি হাই স্কুলে বাঙালি ভাষায় কারিকুলাম করা হয়। বৃটিশ কমিশনারদের অনেক আপত্তি সত্ত্বেও রাজা ভুবন মোহন রায় বাঙালি ভাষায় কারিকুলাম করেন। পাহাড়ে নিয়ে আসা হয় এক ঝাঁক বাঙালি শিক্ষক। এভাবে পোশাকের পর চাকমাদের বাঙালি ভাষা গিলানো হয়।

চাকমাদের স্বকীয়তা নেই বলে, যেটা পাই সেটা অনুসরণ করে। তার নিত্য-নতুনের দিকে আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। ভাষা, পোশাক, সংস্কৃতি কোনোটাই বাদ রাখেনি। ধর্মের, দলের, মানবিক সেবার, নারী অধিকার ও উন্নয়নের নামে তারা যে কি করছে, তারা নিজেরাই বুঝতে পারেনা। ধর্মে যা হচ্ছে সেটি এখন ফ্যাশনকে ডিঙিয়েছে। চীবর দানকে তো দুর্গা পূজা বললেও ভুল হবেনা। বাদ্যযন্ত্র, নাচ, গান, খেলা সবই চলে।

কুকিদের মতো চাকমাদের ভূমি, নিজ ভাষা, সংস্কৃতি কোনোটার প্রতি টান ছিলোনা এবং নেই। তাই এরা যা করে নিজেদের ধ্বংসটা আয়োজন করে। ধর্মের নামে এরা নিজ সামাজিক সংস্কৃতি ও অর্থনীতি ধ্বংস করেছে, রাজনীতি নামে নেতৃত্বশূন্য করেছে, ক্ষমতাকে ব্যবহার করে শোষণের হাতিয়ার হিসেবে হুমকি-ধামকি ও নল তাদের ভাষা, একটু শিক্ষিত হলে এলিট ভাব করা, স্বার্থের পিছনে লেগে থাকা। কুকি নেতাদের মধ্যে ক্ষমতা অপব্যবহারের সুযোগ নেই। করে থাকলে জীবন শেষ। নেতাদের কাজ নেতৃত্ব দেওয়া, ক্ষমতা অপব্যবহার ও স্বার্থ উদ্ধার করা নয়।

লেখক, আমেরিকা প্রবাসী

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Let's check your brain 3 + 5 =

একই ধরনের আরও সংবাদ
© All rights reserved 2022 CHT 360 degree